ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ ছিল এই আন্দোলন। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির অধিকার হরণের চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। পুরো পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬.৪০% মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যালঘিষ্ঠ মাত্র ৩.২৭% জনগোষ্ঠীর ভাষা উর্দুকে তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৮ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত উপেক্ষা করে উর্দু ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করল। বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রথমেই প্রতিবাদ মুখর হলো। তারা অন্যায় বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ১৯৫২ সালে এই আন্দোলন ব্যাপক রূপ লাভ করল। সারা দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে উঠল। পৃথিবীতে ভাষার জন্য প্রথম শহিদ হলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং অনেকে। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিল। যার প্রেরণায় দীর্ঘ সংগ্রামের পর জন্ম নিল আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি-বাংলাদেশ।
 ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের একটি অংশে পরিণত হলো। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি কোনো কিছুরই মিল নেই। প্রথায় এক হাজার মাইল ব্যবধানের পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) দুটি ভূখণ্ডকে এক করা হলো শুধু ধর্মের ভিত্তিতে। ফলে পাকিস্তান নামক এই নতুন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী প্রমেই বাঙালিকে শোষণ করার কৌশল হিসেবে বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানল। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বেই। সে সময় মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এ মর্মে মতামত দেন। তখনই ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ বাংলার বুদ্ধিজীবী, লেখকগণ এর প্রতিবাদ করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ গঠিত হয়। এটিই ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠন। এ সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ প্রকাশিত হয়। পুস্তিকাটিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপদানের জন্য ৪৭-এর অক্টোবর মাসে গঠিত হয় প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, যার আহ্বায়ক মনোনীত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভুঞা। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পাশাপাশি পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব বঙ্গ বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাংবাদিক সংঘ বিভিন্ন সভাসমিতিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এসব কিছুকে উপেক্ষ করে ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সংবিধান সভার কাছে সুপারিশ করে। ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকেই শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় নিম্নশ্রেণী থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুতে কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলা কংগ্রেস পার্টির সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলাকেও অধিবেশনের অন্যতম ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু মুসলিম লীগের সকল সদস্য এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে। এ ঘটনায় পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে। ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ দেশের ছাত্রসমাজ বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় বারের মত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। এবার আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নতুন কমিটির আহ্বানে ১১ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা। ধর্মঘটের পক্ষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানসহ মিছিল করার সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেকেই গ্রেফতার হন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩-১৫ মার্চ আবার ধর্মঘট পালিত হয়। এবার শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিতে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আইন পরিষদে উত্থাপন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রমনার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্য দেন। দুটি বক্তব্যেই তিনি বাংলা ভাষার দাবি অগ্রাহ্য করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। সমাবর্তন বক্তব্যের সময় তিনি বলে উঠলেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। উপস্থিত ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদে ‘না না’ ধ্বনি দিয়ে ওঠে। এ সময় সারা পূর্ব পাকিস্তানেই ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এসে বক্তৃতাকালে আবার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। ছাত্ররা ‘না না’ বলে প্রতিবাদ করে উঠে। ১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে বাংলা ভাষা আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর প্রতিবাদ করেন। আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা হিসেবে বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’ গঠন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির সুপারিশে বলা হয়, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। দেশজুড়ে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ চলতে থাকে। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীখান আততায়ীর হাতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দীন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দীনের এক উক্তিকে কেন্দ্র করে ভাষা আন্দোলন নতুন মাত্রা ও সর্বাত্মক রূপ লাভ করে। এভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনা হয়।

Comments

Post a Comment

Thanks for your comment

Popular posts from this blog

অখন্ড বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দেশ ও সংগঠনের অবদান

খেলাধুলার নিয়ম কানুন (ক্রিকেট, ফুটবলের) সকল নিয়ম