মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত কর্মসূচি এবং আহ্বানের প্রতি সকল স্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়। পূর্ব বাংলার সকল অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বেগতিক দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা করতে ঢাকায় আসেন। এ সময় ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। অপরদিকে ইয়াহিয়া গোপনে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য, গোলাবারুদ এনে পূর্ব বাংলায় সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১৭ মার্চ টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ বা বাঙালির ওপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড পরিচালনার নীলনকশা তৈরি করে। ২৫ মার্চ রাতে পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম গণহত্যা, অপারেশন পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা বিডিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালায় এবং নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত করে, যা ইতিহাসে ২৫ মার্চের কালরাত নামে পরিচিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১- এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই (২৫ মার্চ রাত ১২ টার পর) বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
২৫ মার্চের গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাঙালি তথা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়। সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র, নিরীহ, স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনগণের উপর হামলা করে এবং নির্বাচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তান তাদের এ অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। ২৫ মার্চ এ অভিযান পরিচালনা করলেও মূলত মার্চের প্রথম থেকেই তারা এর পরিকল্পনা করে। একদিকে ১৬ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে সমঝোতা বৈঠক শুরু হয় আর অন্যদিকে জেনারেল টিক্কা খান, মে. জে. খাদিম হোসেন এবং রাও ফরমান আলী অপারেশন সার্চলাইট চূড়ান্ত করেন। ১৯ মার্চ থেকে পূর্ব বাংলায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ শুরু হয়। এ কারণে জয়দেবপুরে সংঘর্ষ বাধে। ২০ মার্চ সরকার অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ জারি করে। ঐদিন জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টা হামিদ খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। এ সময় প্রতিদিন ৬টি থেকে ১৭টি পর্যন্ত পি.আই.এ ফ্লাইট বোয়িং ৭০৭ বিমান সৈন্য ও রসদ নিয়ে ঢাকা আসে এবং অসংখ্য সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই হয়ে আসা জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষা করে। ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে এম.ভি সোয়াত থেকে অস্ত্র ও রসদ খালাস শুরু হয়। সব প্রস্তুতি শেষে ২৫ মার্চ গণহত্যার জন্য বেছে নেয়া হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ঢাকা শহরের মূল দায়িত্ব দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আক্রমণ শুরু হয় গভীর রাতে। জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলে চালায় হত্যা ও পাশবিক নির্যাতন। ২৫ মার্চ রাতে একইভাবে গণহত্যা চলেছিল পুরনো ঢাকায়, কচুক্ষেত, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে, রায়ের বাজার, গণকটুলী, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান প্রভৃতি স্থানে। একইভাবে দেশের অন্যান্য জায়গায় গণহত্যা শুরু করে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তা ওয়্যারলেসযোগে পাঠিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাবাণী শোনামাত্রই চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বাঙালি পুলিশ, আনসার ও সাধারণ মানুষের এক অসম লড়াই যা বাংলাদেশের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত।
স্বাধীনতার ঘোষণা
গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে (২৫ মার্চ রাত ১২ টার পর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এজন্যই ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। ঘোষণাটি ছিল ইংরেজিতে, যাতে বিশ্ববাসী ঘোষণাটি বুঝতে পারেন। স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদ:
‘ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও (বাংলাদেশ গেজেট, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, ৩ জুলাই ২০১১)।’
স্বাধীনতার এ ঘোষণা বাংলাদেশের সকল স্থানে তদানীন্তন ইপিআর এর ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র থেকে একবার এবং সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয়বার প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এর প্রতি বাঙালি সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সমর্থন ও অংশগ্রহণের খবরে স্বাধীনতাকামী জনগণ উজ্জীবিত হয়।
বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠন
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরু হলে প্রাথমিকভাবে পূর্ব প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক তৎপরতা ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার। এ সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায়। শপথ অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। সরকারের প্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নাম অনুসারে বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর এবং অস্থায়ী সরকারও পরিচিত হয় মুজিবনগর সরকার নামে। এ সরকার গঠনের মাত্র দুই ঘণ্টা পর পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান মুজিবনগরে বোমাবর্ষণ করে এবং মেহেরপুর দখল করে নেয়। ফলে মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত হয়।
মুজিবনগর সরকার
রাষ্ট্রপতি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
উপরাষ্ট্রপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং পদাধিকারবলে সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ)
প্রধানমন্ত্রী : তাজউদ্দীন আহমদ
অর্থমন্ত্রী : এম. মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পনু র্বাসন, কৃষিমন্ত্রী : এ.এইচ.এম কামরজ্জু ামান
পররাষ্ট্র, আইনমন্ত্রী ও সংসদবিষয়ক : খন্দকার মোশতাক আহমদ
প্রধান সেনাপতি : কর্নেল (অব.) এম.এ.জি ওসমানী
চিফ অব স্টাফ : লে. কর্নেল (অব.) আবদুর রব
ডেপুটি চিফ অব স্টাফ : গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে খন্দকার
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের ১২টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ছিল। এসব বিভাগের মাধ্যমেই যুদ্ধকালে সামরিক ও বেসামরিক যাবতীয় প্রশাসন পরিচালিত হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশ
২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধবংসলীলায় মেতে উঠেছিল। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে ঢাকায় যে গণহত্যার শুরু করে, এর প্রধান লক্ষ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এদেশের ছাত্রসমাজ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী আর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। কারণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিশ্বাস করত, পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন-সংগ্রামের পেছনে হিন্দুদের হাত রয়েছে, আর এদের ইন্ধন যোগায় ভারত। যদিও ২৫ মার্চ ‘জিরো আওয়ারে’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু করার কথা, তথাপি রাত সাড়ে এগারটার দিকে সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যায় পূর্ব নির্ধারিত গন্তব্যে। ঢাকাসহ সারা দেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল, সলিমুল্লাাহ মুসলিম হল, জগন্নাথ হল এবং বহু শিক্ষকের আবাসিক ভবনে আক্রমণ করে এবং অনেককে হত্যা করে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার ইপিআর হেড কোয়ার্টারসহ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ট্যাংক, কামান, মেশিনগান দিয়ে হামলা করে। শুরু হয় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যার। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ জনতা ঢাকার রাজপথে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করে। অসীম সাহস নিয়ে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী অনায়াসে ভেঙে ফেলে এই প্রতিরোধ। পুরনো ঢাকার নওয়াবপুর, তাঁতি বাজার, শাখারী বাজার এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষোভ যে বেশি ছিল তা এখানাকার নিষ্ঠুর গণহত্যা, নির্যাতন আর ধবংসযজ্ঞ থেকে বোঝা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে হিন্দুমাত্রই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং হিন্দুরা হচ্ছে ‘পবিত্র’ পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। আর এদের পেছনে রয়েছে ভারতের আনুকূল্য ও সমর্থন। এমনি অন্ধবিশ্বাস থেকে গণহত্যা আর নারী নির্যাতনের ভিতর দিয়ে পাকবাহিনীর তীব্র হিন্দু বিদ্বেষ, আক্রোশ আর ভয়ংকর ঘৃণার প্রকাশ ঘটে।
আকস্মিক আক্রমণে নিরীহ, অসহায় নগরবাসী আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই পায়নি। সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে পাকবাহিনীর রোষানলে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুনীরুজ্জামানসহ শত শত ছাত্র হত্যা করা হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা দু’দিন পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মারা যান। পুরনো ঢাকায় বিশেষ করে শাখারীবাজার, তাঁতি বাজারের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার অবস্থা ছিল ভয়াবহ। ঢাকাবাসী দুঃস্বপেড়বও ভাবতে পারেনি তাদের জন্য কী বর্বর, নৃশংস, পৈশাচিক আক্রমণ অপেক্ষা করছে। ঢাকা শহর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। চারদিকে কেবল আর্তনাদ, অসহায় মানুষের হাহাকার। কেবল রাজধানী ঢাকা শহর নয়, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায় পাকবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। আড়াই লাখের অধিক মা-বোন পাকিস্তানিদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে এদেশকে মেধাশূন্য করার জন্য পাকবাহিনী বরেণ্য সাহিত্যিক, শিল্পী, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীকে নিমর্মভাবে হত্যা করে। নির্যাতন, হত্যা, অগিড়বসংযোগ, লুণ্ঠন ইত্যাদি অপরাধ কর্মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহযোগী এদেশীয় ব্যক্তিবর্গ এককথায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত। প্রধানত জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলের সমর্থকরা মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করে। এই দলগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধেও অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছে।
স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপরতা
রাজাকার (রেজাকার) বাহিনী গড়ে তুলেছিল পাকিস্তান সরকার। ১৯৭১ সালের জুন মাসে লে: জেনারেল টিক্কা খান ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স’ জারি করেন। শুরুতে আনসার, মুজাহিদদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়। পরে পাকিস্তানপন্থী অনেকে এই বাহিনীতে যোগ দেয়। এই বাহিনী গঠনে জেনারেল নিয়াজীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।রাজাকারদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল এক সপ্তাহ। রাজাকারদের ট্রেনিং দিতো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। দখলদার বাহিনীর দোসর হিসেবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। রাজাকার বাহিনী ছাড়াও আলবদর নামে আরও একটি ভয়ঙ্কর বাহিনী ছিল। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের সদস্যদের নিয়ে আল্লাবদর বাহিনী গড়ে তোলা হয়। অন্যান্য ইসলামী ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে আল্লাশামস বাহিনী গঠিত হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান দায়িত্ব ছিল আল্লাবদর বাহিনীর ওপর। তাই এই বাহিনী ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও হিংস্র প্রকৃতির। আল্লাবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন বর্তমান জামায়াত ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় প্রথম যে সংগঠনের জন্ম হয় তা হলো ‘শান্তি কমিটি’। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং জামায়াত ইসলামী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াত ওলামায়ে ইসলাম, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলের উৎসাহ ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শান্তি কমিটি বিস্তার লাভ করে। অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যায় এই সংগঠন দখলদার বাহিনীর বিশ্বস্ত সহচর ছিল। কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা খয়েরুদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ‘ঢাকা নাগরিক শান্তি কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটিতে জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম, মৌলভী ফরিদ আহম্মদ, এএসএম সোলায়মান প্রমুখ ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘পোড়া মাটি নীতি’ অনুযায়ী বাংলাদেশের সব সম্পদ-প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে। যে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকান-পাট, ঘর-বাড়ি, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির কোনো কিছুই তাদের হাত থেকে রেহাই পায় নি। তাদের লক্ষ্য ছিল এই ভূখণ্ডের মানুষদের হত্যা করে কেবল ভূমির দখল নেওয়া। পাক বাহিনীকে এ সমস্ত মানবতাবিরোধী অপকর্মে সহায়তা করেছে এদেশীয় কিছু দালাল চক্র।
মুজিবনগর সরকারের অধীনে প্রশাসন ও যুদ্ধ :
১৯৭০-৭১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য দ্বারা মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করা ছিল এ সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। বাঙালি কর্মকর্তাদের নিয়ে সরকার প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করেন। এতে মোট ১২টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ছিল। এগুলো হচ্ছে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থ-শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়, সাধারণ প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিভাগ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, যুব ও অভ্যর্থনা শিবিরের নিয়ন্ত্রণ বোর্ড ইত্যাদি। মুজিবনগর সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে (কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, স্টকহোম) বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপন করে। এসব মিশন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিশেষ দূত নিয়োগ দেয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব নেতৃত্ব ও জনমতের সমর্থন আদায়ের জন্য কাজ করেন। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক, বেসামরিক জনগণকে নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
১০ এপ্রিল সরকার ৪টি সামরিক জোনে বাংলাদেশকে ভাগ করে ৪ জন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করে। ১১ এপ্রিল তা পুনর্নির্ধারিত করে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এ ছাড়া বেশ কিছু সাব-সেক্টর এবং তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠিত হয়। এসব বাহিনীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, সেনাসদস্য, পুলিশ, ইপিআর, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যগণ যোগদান করেন। প্রতিটি সেক্টরেই নিয়মিত সেনা, গেরিলা ও সাধারণ যোদ্ধা ছিল। এরা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিফৌজ নামে পরিচিত ছিল। এসব বাহিনীতে দেশের ছাত্র, যুবক, নারী, কৃষক, রাজনৈতিক দলেরকর্মী -সমর্থক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিল। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে যোদ্ধাগণ দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সামরিক ছাউনি বা আস্তানায় হামলা চালায়। মুক্তিযুদ্ধে সরকারের অধীন বিভিন্ন বাহিনী ছাড়াও বেশ কয়েকটি বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছিল। এ সব সংগঠন স্থানীয়ভাবে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। যেমন: টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর কথা স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাগণ মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে দেশকে পাকিস্তানিদের দখলমুক্ত করার জন্য রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছেন, অনেকেই দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন সংগঠন
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাভাবিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মতভেদ লক্ষ করা যায়। বাম রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকলেও একটি অংশ বিরুদ্ধে ছিল। অন্য দিকে পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো কেবল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তাই নয়, তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল হলো আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট যোগ্যতা, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সমমনা বাম রাজনৈতিক দলসমূহ নিয়ে আওয়ামী লীগ একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ-ভাসানী), মণি সিং (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি), মনোরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস), অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ (ন্যাপ-মুজাফফর) এবং আওয়ামী লীগ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। তবে পিকিং পন্থী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মতিন-আলাউদ্দীন) মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা এদেশের জনগণকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করেছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, নারী, শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ মুক্তির সংগ্রামে শামিল হয়।
ছাত্র
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল ছাত্র। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ছাত্ররা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাশাপাশি স্কুলপড়–য়া কিশোরও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যায়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ সরকার ছাত্র-যুবকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের সংস্থান করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাত্র তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ আর হালকা অস্ত্র নিয়ে অসীম সাহস, মনোবল আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিসেনার দল।
কৃষক
মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের অবদান ছিল অত্যন্ত গৌরবময়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন তারা। শত্রুর বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রতিটি আক্রমণে তারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাব তাঁদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। একটাই লক্ষ্যÑযেকোনো মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।
নারী
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম থেকেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তাতে নারীদের বিশেষ করে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। দেশকে স্বাধীন করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। যুদ্ধের নয় মাসে কয়েক লক্ষ মা-বোন পাক বাহিনীর অত্যাচারের শিকার হয়। তাঁদের বঙ্গবন্ধু কন্যার ন্যায় মমতায় সম্বোধন করেছেন ‘বীরাঙ্গনা’ বলে। এর বাইরে বিরাটসংখ্যক নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, খাবার দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, সেবা দিয়ে, নানাভাবে সহায়তা করেছেন। এমন কী প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের দৃষ্টান্তও কম নয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ দু’জন নারী ‘বীর প্রতীক’ খেতাব অর্জন করেন। একজন তারামন বিবি, অন্যজন ডাক্তার সিতারা বেগম। সারা দেশে আরও অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানবাহিনীর মোকাবেলা করেছেন।
গণমাধ্যম
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। সংবাদপত্র ও স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেন। পরে এটি মুজিবনগর সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র সংবাদ, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা রণাঙ্গনের নানা ঘটনা ইত্যাদি দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত করে; মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়ে বিজয়ের পথ সুগম করে। এছাড়া মুজিবনগর সরকারের প্রচার সেলের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে।
প্রবাসী বাঙালি
প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। বিভিন্ন দেশে তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে পার্লামেন্ট সদস্যদের নিকট ছুটে গিয়েছেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেছেন, পাকিস্তানকে অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ না করতে সরকারের নিকট আবেদন করেছেন। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে তারা কাজ করেছেন।
শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী
মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি ছিল জনগণ। তথাপি যুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শিল্পী-সাহিত্যিক- বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন সংস্কৃতি কর্মীর অবদান ছিল খুবই প্রশংসনীয়। এমনকী নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। পত্রপত্রিকায় লেখা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর পাঠ, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, কবিতা পাঠ, নাটক, কথিকা, এম আর আকতার মুকুলের অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান এবং ‘জল্লাাদের দরবার’ ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধকে এগেিয় নিতে সহায়তা করে। এসব রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক ও নৈতিক বল ধরে রাখতে সহায়তা করেছে, সাহস জুগিয়েছে, জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় করেছে। সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন আহমদসহ এমনি অগণিত গুণীজনকে হত্যা করেছে পাকিস্তানবাহিনী। তাঁদের অমূল্য জীবনের বিনিময়ে এদেশ শক্রমুক্ত হয়েছে।
জনসাধারণ
সাধারণ জনগণের সাহায্য-সহযোগিতা ও স্বাধীনতার প্রতি ঐকান্তিক আকাক্সক্ষার ফলেই মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক দোসর ব্যতীত সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, শত্রুর অবস্থান ও চলাচলের তথ্য দিয়েছে, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করেছে, সেবা দিয়েছে ও খবরাখবর সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণও এতে অংশগ্রহণ করে। অনেকে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহিদের মধ্যে সাধারণ মানুষের সংখ্যা ছিল অধিক। এদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীন মানচিত্র, লাল্লাসবুজ পতাকা।

Comments
Post a Comment
Thanks for your comment