বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ


১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করায়, পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। সারা দেশেব্যাপী নানারকম উদ্বেগ, উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল জাতির জন্য সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল নামে। বঙ্গবন্ধুএ সমাবেশে যে ভাষণ দেন তা বিশ্বের ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছে। তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল ৪টি। যথা: ১. চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহার;
২. সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া ;
৩. গণহত্যার তদন্ত করা এবং;
৪. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এর বাইরে আরও বেশ কিছু দাবি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উত্থাপন করা হয়। তিনি বাংলাদেশের সকল অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। এ সমাবেশে সামরিক সরকারের কড়া নজর ছিল। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হবে। তাই কৌশলগত কারণে প্রত্যক্ষভাবে ঘোষণা না দিয়ে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘আমার অনুরোধ, প্রত্যেক মহল্লাায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি মুক্তি সংগ্রামের জন্য সকলকে প্রস্তুত হওয়ার আদেশও দেন এবং দেশকে শক্রমুক্ত করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানান। তাঁর এ ভাষণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামে প্রচারিত হয়, যা বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরদিন থেকে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। তাঁর নির্দেশ অনুসারে দেশের স্কুল কলেজ, অফিস-আদালত, কল্লাকারখানা সব বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ করতে থাকে। খাজনা-ট্যাক্স আদায় বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করেন। ১০ মার্চ সরকার এক সামরিক আদেশ জারি করে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কর্মস্থলে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু এর পরও পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৩ মার্চ সরকার পুনরায় সামরিক আইন জারি করে। ১৪ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি অবাস্তব প্রস্তাবের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ফর্মুলা দেন। তবে বঙ্গবন্ধু এসব কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ঐ দিনই ৩৫ দফাভিত্তিক দাবিনামা জারি করেন। সেখানে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনসাধারণকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর আদেশ জারির পর থেকে শুধু সেনাবাহিনী ছাড়া সর্বত্র আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অবস্থার গভীরতা উপলব্ধি করে ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকা সফরে আসেন। এখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধু আলোচনার জন্য রাজি হলেও অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেননি। ১৬ মার্চ থেকে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা শুরু হয়। এরপর ২২ মার্চ হঠাৎ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা আসেন এবং আলোচনায় অংশ নেন। এরমধ্যে ১৯ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা জয়দেবপুরে নিরীহ মানুষের ওপর হামলা চালালে এর প্রভাব মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনাকে প্রভাবিত করে। মূলত এসময় আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে এদেশের ঘরে ঘরে পাকিস্তানের পতাকার বদলে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ সংকট সমাধানের শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু আলোচনা অসমাপ্ত রেখে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার আগে তিনি সামরিক বাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিয়ে যান। ফলে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাঙালির ওপর নেমে আসে চরম আঘাত। সেদিন রাতে পাকিস্তানি সেনারা বহু বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করে।

Comments

Popular posts from this blog

অখন্ড বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দেশ ও সংগঠনের অবদান

খেলাধুলার নিয়ম কানুন (ক্রিকেট, ফুটবলের) সকল নিয়ম