ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়

নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে ঘোষণা দেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এর প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারি সভা ও ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান করে। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সর্বদলীয় সভায় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব। এ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসময় হঠাৎ করে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ করেন। সরকারি এ ঘোষণা পাওয়া মাত্রই ঢাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা কিছুতেই ১৪৪ ধারা মেনে নিতে পারেনি।
 ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে।আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে এ সভায় ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্তে দ্বিমত দেখা দেয়। অধিকাংশ সদস্য প্রথমে ১৪৪ ধারা অমান্য করার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু আবদুল মতিন, ওলি আহাদ, গোলাম মাহবুব প্রমুখ নেতারা ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্তে অটুট থাকেন। অবশেষে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চত্বরে) ছাত্রদের সভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সমাবেশে যোগ দেয়। কতিপয় নেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করে। তবে ছাত্র নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্তে অটল থাকে। সভায় ছোট ছোট দলে ছাত্ররা মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। ছাত্র-ছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে।
ছাত্র-ছাত্রীরাও পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে সমবেত হয়ে গণপরিষদের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে আবদুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার ঘটনাস্থলে শহিদ হন। সে সময় গণপরিষদের অধিবেশন চলছিল। গুলির খবর পেয়ে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ আইন পরিষদের কয়েকজন সদস্য অধিবেশন ত্যাগ করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।
বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি গণবিক্ষোভ শুরু হয়। জনতা শহিদদের জন্য শোক মিছিল বের করে। আবারও মিছিলের ওপর পুলিশ ও মিলিটারি লাঠি, গুলি ও বেয়োনেট ব্যবহার করে। এতে শফিউর রহমানসহ আরও কয়েকজন শহিদ হন। অনেকে গ্রেফতার হন। ছাত্ররা যে স্থানে গুলিতে নিহত হয় সেখানে ছাত্ররা সারারাত জেগে ২৩ ফেব্রুয়ারিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বা শহিদ মিনার নির্মাণ করে। পরে পুলিশ শহিদ মিনারটি ভেঙে দেয়। ১৯৬৩ সালে অস্থায়ী শহিদ মিনারের স্থলে শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনায় শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী শহিদ মিনারটি ভেঙে দিলে ১৯৭২ সালে সে নকশা অনুযায়ী বর্তমান শহিদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়।
তারপরেও ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। প্রবল আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জাতীয় পরিষদে বাংলা ভাষা বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের একপর্যায়ে এর সদস্য আদেলউদ্দিন আহমদের দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিল পাস করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।
ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে এটি ছিল বাঙালি জাতির প্রথম প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রেরণা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের অবহেলা, বঞ্চনা, শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবমাননা বাঙালির মনকে প্রবল নাড়া দিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানিদের হাতে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি কিছুই নিরাপদ নয়। এভাবেই বাঙালির মাঝে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপিত হয়। যার ফলে সম্ভব হয় ষাটের দশকের স্বাধিকার আদায়ের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন। যার হাত ধরে স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে স্বাধীনতার দাবি এবং তারই ফলে বীর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।

শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরের বছর থেকে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি বাঙালির শহীদ দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন। ২১-এর প্রভাতফেরি ও প্রভাতফেরির গান বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন ঘোষিত হয়। এদিন শহীদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালি চেতনাকে লালন করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতি রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল। বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য সাধারণ ঘটনা হিসেবে আমাদের ভাষা ও শহিদ দিবস আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষাণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এই দিবস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে। এভাবে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভূষিত হয়। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি। এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা পোষণে এবং সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

Comments

Post a Comment

Thanks for your comment

Popular posts from this blog

অখন্ড বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দেশ ও সংগঠনের অবদান

খেলাধুলার নিয়ম কানুন (ক্রিকেট, ফুটবলের) সকল নিয়ম