স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত আমাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। বিশেষভাবে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিলে ‘যৌথ কমান্ড’ গঠন ছিল অত্যন্ত গুরুত্ব ঘটনা। পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করলে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ৬-১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতের সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীও পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। যৌথ বাহিনীর সুপরিকল্পিত প্রবল আক্রমণে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের পূর্বেই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর নৈতিক পরাজয় ঘটে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল চারটা একুশ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল আমীর আবদুল্লাাহ খান নিয়াজী প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্যসহ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার। ত্রিশ লক্ষ শহীদ, কয়েক লক্ষ মা-বোনের সীমাহীন কষ্ট, নিপীড়ন আর ত্যাগের বিনিময়ে এই মহান স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে স্বাধীন,,
সার্বভৌম রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
সার্বভৌম রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
বিশ্ব ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে প্রথম দেশ, যে দেশ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ১৯৪৭ সাল থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা পূর্ব বাংলার জনগণ সর্বপ্রকার অত্যাচার, শোষণ, বৈষম্য, জাতি নিপীড়নের শিকার হয়েছে। কিন্তু এ ভূখণ্ডের সংগ্রামী মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ডাক দেন এবং ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রদান করেন, ১৬ ডিসেম্বর তা বাস্তবে পূর্ণতা পায়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বপ্রকার সহযোগিতা করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় বাঙালির শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ এ অঞ্চলের বাঙালি এবং এ ভূখণ্ডে বসবাসকারী অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর জনগণের মধ্যে নতুন যে দেশপ্রেমের জন্ম দেয়, তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধ শেষে জনগণ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নপূরণ হলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের নিপীড়িত, স্বাধীনতাকামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করে।
বাংলাদেশ নামের ইতিহাস
আমরা জানি, আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। তবে সংবিধান অনুযায়ী নাম হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এই নামেরও একটা ইতিহাস আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের নামের সঙ্গে ভূখণ্ডের সীমানার সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর নানা সময়ে এর সীমানার বদল হয়েছে। প্রাচীনকালে আমাদের বাংলাদেশ নানা জনপদে বিভক্ত ছিল। তা এই গ্রন্থের শুরুর দিকে আলোচনা করা হয়েছে। মহাভারত এবং গ্রিক ঐতিহাসিক টলেমির লেখায় ‘বাংলা’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার অনেক পরে ১৩৪২ সালে শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম বাংলার তিনটি প্রধান কেন্দ্র লখনৌতি বা লক্ষণাবতী (গৌড়), সাতগাঁও (রাঢ়) ও সোনারগাঁও (বঙ্গ)-কে একত্র করে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর স্বাধীনতা ২০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ইলিয়াস শাহের উপাধি ছিল ‘শাহ-ই-বাঙ্গালা’, ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’, ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’। আর তখন থেকে সমগ্র বাংলা অঞ্চল ‘বাঙ্গালাহ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। রাজধানী হলো সোনারগাঁও। মুঘল আমলে সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলার পরিচয় হয় ‘সুবাহ বাংলা’ নামে। তবে ইউরোপীয়রা বিশেষভাবে পর্তুগিজরা ‘বেঙ্গালা’ নামে অভিহিত করেছেন এই অঞ্চলকে। তবে ইংরেজরা বলতেন ‘বেঙ্গল’। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বাংলা নামে পৃক প্রদেশ করা হয়। বাংলার অধীনে ছিল বিহার, উড়িষ্যা এবং ছোটনাগপুর। পরবর্তীতে ১৯০৫ সালে বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের আসাম নিয়ে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়। আন্দোলনের মুখে ৬ বছর পরে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে ইংরেজ সরকার। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান হলে পশ্চিম বঙ্গ ভারতে আর পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তান আমলেও ১৯৫৬ সাল অবধি আজকের বাংলাদেশ ‘পূর্ব বঙ্গ’ নামেই পরিচিত ছিল। পাকিস্তান সরকার পূর্ব বঙ্গ পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করলে বঙ্গবন্ধু এর বিরোধিতা করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলা নামের দীর্ঘ ইতিহাস ঐতিহ্য আছে। তাই বাংলার নাম পরিবর্তনের পূর্বে গণভোটের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের মতামত গ্রহণ করতে হবে। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ।
জাতীয় পতাকার ইতিহাস
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আমাদের অহংকার আর গৌরবের প্রতীক। অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে লালসবুজের এই পতাকা এদেশের জনগণ অর্জন করেছে। জাতীয় পতাকার সবুজ আয়তক্ষেত্র বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির প্রতীক, আর বৃত্তের লাল রং মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের রক্তের প্রতীক। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পতাকায় লাল বৃত্তে বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত ছিল। মানচিত্র খচিত পতাকার মাধ্যমে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে কোন ভূখণ্ডে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। মানচিত্র খচিত এই পতাকা আমাদের সংগঠিত, একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা ডিজাইন করেছেন শিবনারায়ণ দাস। তিনি ছিলেন তৎকালীন কুমিল্লাা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি। সে সময়ের প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলা বিপ-বী পরিষদ’ শিবনারায়ণ দাসকে পতাকা তৈরির দায়িত্ব দেয়। ১৯৭০ সালের ৬ জুন গভীর রাতে অত্যন্ত গোপনভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের ১১৮ নম্বর কক্ষে পতাকা তৈরির কাজ সম্পন্ন করেন শিবনারায়ণ দাস।১৯৭১ সালের অগিড়বঝরা মার্চে যখন উত্তাল সারা দেশ, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের পশ্চিম দিকের গেটে শিবনারায়ণ দাসের ডিজাইনকৃত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ২ মার্চ, ১৯৭১ প্রথমবারের মতো উত্তোলন করেন ছাত্রনেতা আ.স.ম. আব্দুর রব। এ যেন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যানের শামিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ইতোমধ্যে সারা দেশে শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে ঘটে গেল অভাবনীয় ঘটনা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হলো। বহু বাড়ি-ঘরে উড়ানো হলো বাংলাদেশের পতাকা। পাকিস্তানের প্রত্যাখ্যাত পতাকা আর ফিরে আসতে পারে নি। ত্রিশ লক্ষ শহীদ জীবন দিয়েছেন বাংলাদেশের পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে পটুয়া কামরুল হাসানকে দায়িত্ব দেন জাতীয় পতাকার ডিজাইন চূড়ান্ত করার। পটুয়া কামরুল হাসানের হাতেই আমাদের জাতীয় পতাকা বর্তমান রূপ লাভ করেছে। জাতীয় পতাকা একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। জাতীয় পতাকার সম্মানের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্মান-মর্যাদা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই পতাকার সম্মান রক্ষা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
জাতীয় সংগীতের ইতিহাস
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ সংগীতটি আমাদের জাতীয় সংগীত। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সংগীত রচনা করেন। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে স্বদেশী আন্দোলনের সময় এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) বিরোধী রাজনীতিবিদ, স্বদেশী কর্মী ও বিপ্লবী বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে গানটি প্রচার করে। কিন্তু বিশ শতকের বিশের দশকে আঞ্চলিক জাতীয়বাদ স্তিমিত হয়ে পড়লে এ গানটির প্রচলন কমে যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটির পুনরুজ্জীবন ঘটে। গানটি ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকায় এক বিশাল জনসভায় এবং পরে ৩ মার্চ ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত জনসভায় পুনরায় গাওয়া হয়। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণের প্রাক্কালে গানটি গাওয়া হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এই গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হয়। স্বাধীনতার পর সাংবিধানিকভাবে (অনুচ্ছেদ ৪.১) ‘আমার সোনার বাংলা’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে ঘোষিত হয়। গানের প্রথম ১০ লাইন কণ্ঠ সংগীত এবং প্রথম ৪ লাইন যন্ত্র সংগীত হিসেবে পরিবেশনের বিধান রাখা হয়।বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত :
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে⎯
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী সেড়বহ, কী মায়া গো⎯
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি॥
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের আনুষ্ঠানিকতা
ক. স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শহীদ দিবসের মতো বিশেষ দিনগুলোতে সম্পূর্ণ জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে।
খ. রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী যেসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন, সেসব অনুষ্ঠানে তাঁদের আগমনের ও প্রস্থানের সময় সম্পূর্ণ জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে।
গ. কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মানে গার্ড অব অনার প্রদানকালে রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন প্রদানের সময় পূর্ণ জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রমে অতিথি দেশের জাতীয় সংগীত এবং পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে। কিন্তু অতিথি সরকার প্রধান হলে কেবল প্রথম চার লাইন পরিবেশিত হবে।
ঘ. বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাসগুলোর সরকারি অনুষ্ঠানে কেবল প্রথম চার লাইন পরিবেশিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রথমে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং পরে সংশি-ষ্ট দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হবে।
ঙ. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও কূটনৈতিক মিশন আয়োজিত অন্যান্য সকল অনুষ্ঠান, বিশেষ অনুষ্ঠান ও জনসভায় অনুমোদিত বিধি অনুযায়ী জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে।
জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ
জাতীয় স্মৃতিসৌধ
মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নাম না-জানা শহীদদের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এটি ঢাকা শহর থেকে ৩৫ কি:মি: উত্তর-পশ্চিমে সাভারে অবস্থিত। স্থপতি মঈনুল হোসেনের নকশা অনুযায়ী জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সাতটি জোড়া ত্রিভুজাকার দেয়ালের মাধ্যমে ছোট থেকে বড় হয়ে ধাপে ধাপে সৌধটি ১৫০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছে। সমগ্র স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের মূল বেদীতে যেতে হলে বেশ দীর্ঘ উঁচু-নিচু পথ, পেভমেন্ট ও একটি কৃত্রিম লেকের উপর নির্মিত সেতু পার হতে হয়। এই সবকিছ্ইু আসলে আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক। পাশেই রয়েছে গণকবর, যাঁদের অমূল্য জীবনের বিনিময়ে এদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে। মূল স্মৃতিসৌধে সাত জোড়া দেয়াল, মূলত বাঙালির গৌরবময় সংগ্রামের প্রতীক। এই রাজনৈতিক ঘটনাগুলো হলো ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সালের মধ্যেই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস নিহিত। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনার ফলেই পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আর জাতীয় স্মৃতিসৌধ বারবার আমাদের সেই মহান শহীদদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ১৯৭২ সালে জাতীয় স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৮২ সালে তিনটি পর্যায়ে তা সম্পন্ন হয়। বাঙালির অহংকার, গৌরব আর মর্যাদার প্রতীক এই স্মৃতিসৌধ।
অপরাজেয় বাংলা
বাঙালির প্রতিবাদী মনোভাব ও মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াকু চেতনার মূর্ত প্রতীক অপরাজেয় বাংলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে ৬ ফুট উঁচু বেদির ওপর নির্মিত। মূল ভাস্কর্যের উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রসমাজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি সংগ্রামে ছাত্রদের গৌরবময় ত্যাগকে স্মরণীয় করার জন্য অপরাজেয় বাংলা নির্মাণ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাাহ খালিদ এটি নির্মাণ করেন। ১৯৭৩-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এই ভাস্কার্যের নির্মাণকাজ চলে। এই ভাস্কর্যে অসমসাহসী তিনজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব অপূর্ব দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুইজন তরুণ রাইফেল হাতে শত্রুর মোকাবেলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর ঔষধের ব্যাগ কাঁধে তরুণী মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। অপরাজেয় বাংলা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ
মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী মুজিবনগর সরকারের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিসৌধে ২৪টি পৃক ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল বৃত্তাকারে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে সর্বশেষ উচ্চতায় স্থির হয়েছে। ২৪টি ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল হলো ২৪ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষণের প্রতীক। ১৯৪৭ সাল থেকে এদেশের জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ক্রমে সংগঠিত হয়েছে। একপর্যায়ে দৃঢ় মনোবল আর সংকল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। কারণ এখানেই শপথ নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। স্থপতি হলেন তানভীর করিম।বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় অগণিত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মানবতাবিরোধী এই বর্বর কাজে সহায়তা করেছে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। পাক বাহিনী চূড়ান্ত পরাজয়ের দু’দিন পূর্বে ১৪ ডিসেম্বর অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। তাঁদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ঢাকার মিরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এর স্থপতি ছিলেন মোস্তফা আলী কুদ্দুস। ১৯৭২ সালে এই স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ শেষ হয়।
শিখা চিরন্তন
মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদদের অমর স্মৃতি চির জাগরুক রাখার জন্য ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ শিখা চিরন্তন স্থাপিত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে এই স্থান থেকেই ‘মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের’ ডাক দিয়েছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন স্থাপন করা হয়।
রায়েরবাজার বধ্যভূমি
মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে অগণিত বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১ সালে রায়েরবাজার এলাকাটি ছিল বেশ নিরিবিলি। জনবসতি খুব একটা চোখে পড়ত না। কালুশাহ পুকুরপাড় থেকে গোল মসজিদ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য প্রায় তিন কিলোমিটার হবে। মার্চ মাস থেকেই রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। এখানে মানুষকে শুধু হত্যা করা হয়েছে তা নয়, অগণিত লাশ এনে ফেলা হয়েছে এই বধ্যভূমিতে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এখানকার ইটখোলার রাস্তা দিয়ে লোকজন হাঁটাচলার সাহস করত না। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। সেদিন এই বধ্যভূমির বিভিন্ন গর্ত থেকে প্রচুর গলিত ও বিকৃত লাশ উদ্ধার করা হয়। এখানে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসকের লাশই অধিক ছিল। বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডে আলবদর ও রাজাকাররা প্রধান ভূমিকা পালন করে। রায়েরবাজারে উদ্ধারকৃত লাশের অধিকাংশ এতটাই বিকৃত হয়ে পড়ে যে পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। তবে যে কয়েকজনের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে, তাঁরা হলেন- অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ডা: ফজলে রাব্বি প্রমুখ।

Comments
Post a Comment
Thanks for your comment