Partition of Bengal 1905-1911

বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫ খ্রিঃ-১৯১১খ্রিঃ)

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদয়ের সম্প্রীতি চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরকে শত্রু ভাবতে শুরু করে। উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে থাকে। নেতাদের উদার প্রচেষ্টা, বিভিন্ন যৌথ রাজনৈতিক কর্মসূচির ফলে মাঝে মাঝে ঐক্যের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ বিভেদ নীতিরই জয় হয়। উভয় সম্প্রদয়ের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও শত্রুতার অবসান ঘটে। পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হয়।
 বঙ্গভঙ্গ পটভূমি : ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলা ভাগ করেন। এই বিভক্তি ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। ভাগ হবার পূর্বে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যে প্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ দিয়ে গঠিত ছিল বাংলা প্রদেশ বা বাংলা প্রেসিডেন্সি। বঙ্গভঙ্গের এই পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে ছিল। বাংলা প্রেসিডেন্সির আয়তন অনেক বড় হওয়ার কারণে ১৮৫৩ থেকে ১৯০৩ খ্রিঃ পর্যন্ত এর সীমানা পুনর্বিন্যাসের অনেক প্রস্তাব ব্রিটিশ সরকারি মহলে উপস্থাপন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯০৩ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ১৯০৪ সালে ভারত সচিব এটি অনুমোদন করেন এবং ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। এই বছর অক্টোবর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, আসাম, জলপাইগুড়ি, পার্বত্য ত্রিপুরা ও মালদহ নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব বাংলা ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ। প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা। অপরপক্ষে পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম বাংলা প্রদেশ, যার রাজধানী হয় কলকাতা।
 বঙ্গভঙ্গের কারণ : বঙ্গভঙ্গের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, যা নিচে উল্লেখ করা হলো
প্রশাসনিক কারণ : লর্ড কার্জনের শাসনামলে বঙ্গভঙ্গ ছিল একটি প্রশাসনিক সংস্কার। উপমহাদেশের এক-তৃতীয়াংশ লোকের বসবাস ছিল বাংলা প্রেসিডেন্সিতে। কলকাতা থেকে পূর্বাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা ছিল কঠিন কাজ। যে কারণে লর্ড কার্জন এত বড় অঞ্চলকে একটিমাত্র প্রশাসনিক ইউনিটে রাখা যুক্তিসংগত মনে করেননি। তাই ১৯০৩ সালে বাংলা প্রদেশকে দুভাগ করার পরিকল্পনা করেন এবং ১৯০৫ সালে তা কার্যকর হয়।
 আর্থ-সামাজিক কারণ : বাংলা ভাগের পেছনে আরো কারণ ছিল যার একটি অর্থনৈতিক, অপরটি সামাজিক। তৎকালীন সময়ে কলকাতা হয়ে উঠেছিল আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। শিল্প, কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতাকে ঘিরে। যা কিছু উন্নতি অগ্রগতি, সবকিছুই ছিল কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে পূর্ব বাংলার উন্নতি ব্যাহত হয়। অথচ এখান থেকে যে কাঁচামাল সরবরাহ করা হতো তার জন্যও সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না। ফলে পূর্বে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমে ক্রমে খারাপ হতে থাকে। উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারার কারণে এ অঞ্চলের লোকজন অশিক্ষিত থেকে যায়। কর্মহীনদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে। এ অবস্থার কথা বিবেচনা করে বঙ্গভঙ্গের প্রয়োজন ছিল।
 রাজনৈতিক কারণ: লর্ড কার্জন শুধু শাসন-সুবিধার জন্য বা পূর্ব বাংলার জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে বঙ্গভঙ্গ করেননি। এর পেছনে ব্রিটিশ প্রশাসনের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত ছিল। লর্ড কার্জন বাংলার রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ক্রমশ জাতীয়তাবাদ ও রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। কংগ্রেস নেতারা কলকাতা থেকেই সারা ভারতের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন। সুতরাং কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। হিন্দু ও মুসলমান সম্মিলিত শক্তি, ঐক্যবদ্ধ বাংলা ছিল বৃটিশ প্রশাসনের জন্য বিপদজনক। ফলে বাংলা ভাগ করে একদিকে বাঙালির শক্তিকে দুর্বল করা হলো, অপরদিকে পূর্ব বাংলার উন্নয়নের নামে মুসলমান সম্প্রদায়কে খুশি করা হলো। এভাবেই কার্জন ‘বিভেদ ও শাসন’ নীতি প্রয়োগ করে যতটা না পূর্ব বাংলার কল্যাণে, তার চেয়ে বেশি ব্রিটিশ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বাংলা ভাগ করেন। এভাবে কৌশলে ভারতীয় জাতীয় ঐক্যকে দুর্বল করার ব্যবস্থা করা হলো।
 বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া: বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার ফলে বাংলার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়। মুসলিম পত্র-পত্রিকাগুলোও বঙ্গ বিভাগে সন্তোষপ্রকাশ করে। নতুন প্রদেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল মুসলমান। সুতরাং পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায় শিক্ষা-দীক্ষা এবং প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে এ আশায় তারা বঙ্গভঙ্গের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করে। অপর দিকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এর পেছনে কারণ সম্পর্কে কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন উঁচুতলার মানুষ অর্থাৎ পুঁজিপতি, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, জমিদার, আইনজীবী, সংবাদপত্রের মালিক, রাজনীতিবিদ এদের স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে এরা বঙ্গভঙ্গের ঘোর বিরোধিতা শুরু করে।
 তবে ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার কারণে হোক বা জাতীয় ঐক্যের মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হোক, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। এই আন্দোলনে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, অশ্বিনীকুমার দত্ত, বালগঙ্গাধর তিলকসহ গোখলের মতো উদারপন্থী নেতাও অংশ নেন। সুখেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বঙ্গভঙ্গকে জাতীয় দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ক্রমে স্বদেশী আন্দোলনে রূপ নেয়। চরমপন্থী নেতাদের কারণে এই আন্দোলনের সঙ্গে সশস্ত্র কার্যকলাপও যুক্ত হয়। ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের দমন করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত করে। রাজা পঞ্চম জর্জ ভারত সফরে এসে ১৯১১ সালে দিল্লির দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দেন।
বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হিন্দু সম্প্রদায় খুশি হয়, আর কংগ্রেস মনে করে এটি তাদের নীতির জয়। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গ রদে প্রচণ্ড মর্মাহত হয়। তাদের ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেসের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে কংগ্রেস মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়। মুসলিম নেতৃবৃন্দ একে ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার জঘন্য উদাহরণ বলে মন্তব্য করেন। বঙ্গভঙ্গের পর থেকে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরে। এরপর থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হলে হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক পথ আলাদা হয়ে যায়। মুসলমানদের জন্য ক্রমশ স্বতন্ত্র জাতি-চিন্তা তীব্র হতে থাকে।
 স্বদেশী আন্দোলন
ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যর্থ হলে কংগ্রেসের উগ্রপন্থী অংশের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠে, তাকেই স্বদেশী আন্দোলন বলা হয়। এ আন্দোলনের মূল কর্মসূচি ছিল দুটি বয়কট ও স্বদেশী। বয়কট আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিলেতি পণ্য বর্জন। ক্রমে ক্রমে বয়কট শব্দটি ব্যাপক অর্থ ব্যবহার হতে থাকে। বয়কট শুধু বিলেতি পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বিলেতি শিক্ষা বর্জনও কর্মসূচিতে যুক্ত হয়। ফলে স্বদেশী আন্দোলন শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে রূপ নেয়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন করার অপরাধে সরকারি স্কুল কলেজ থেকে বহু শিক্ষার্থীকে বের করে দেওয়া হয়, যে কারণে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দেয়। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ফলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং কয়েকটি কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্রও গড়ে উঠে। স্বদেশী আন্দোলন ক্রমশ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিলেতি শিক্ষা বর্জনের মতো পণ্য বর্জনের জন্যও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। স্থানে স্থানে সমিতির মাধ্যমে বিলেতি পণ্য বর্জন এবং দেশীয় পণ্য ব্যবহারে শপথ নেওয়া হয়। কংগ্রেস নেতারা গ্রামে-গঞ্জে-শহরে প্রকাশ্য সভায় বিলেতি পণ্য পুড়িয়ে ফেলা এবং দেশীয় পণ্য ব্যবহারের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে থাকেন। ফলে বিলেতি পণ্যের চাহিদা কমে যেতে থাকে।
 একই সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এ সময় দেশি তাঁতবস্ত্র, সাবান, লবণ, চিনি ও চামড়ার দ্রব্য তৈরির কারখানা গড়ে উঠে। স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যুক্ত হতে থাকে। আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন বাড়াবার জন্য বাংলার জেলায় জেলায় বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেমন ঢাকায় অনুশীলন, কলকাতায় যুগান্তর সমিতি, বরিশালে স্বদেশী বান্ধব, ফরিদপুর ব্রতী, ময়মনসিংহে সাধনা ইত্যাদি সংগঠনের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কবি-সাহিত্যিকরা দেশাত্মবোধক বিভিন্ন রচনাপত্র পত্রিকায় লিখতে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রজনীকান্ত সেন প্রথমুখ। বরিশালের চারণ কবি মুকুন্দ দাস গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে আন্দোলনের পক্ষে মানুষের মনে দেশপ্রেথম জাগাতেও সক্ষম হন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাগুলোও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে বেঙ্গলী, সঞ্জীবনী, যুগান্তর, অমৃতবাজার, সন্ধ্যা, হিতবাদীসহ অন্য বাংলা-ইংরেজি পত্রিকাগুলো স্বদেশ প্রেথম ও বাঙালি জাতি চেতনায় সমৃদ্ধ লেখা ছাপাতে থাকে।
 বাংলার নারী সমাজ স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশ নিতে শুরু করে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পূর্ব বঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থবিরোধী হলেও কিছু মুসলমান নেতা প্রাথমিক পর্যায়ে সমর্থন করলেও পরবর্তীতে স্বদেশী বয়কট আন্দোলনে যোগ দেননি। তাছাড়া স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে হিন্দুধর্মের আদর্শ-আচার অনুষ্ঠানের প্রভাব থাকার কারণে মুসলমান সমাজ এ থেকে দূরে থাকে। স্বদেশী আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থক ছিল বাংলার জমিদার শ্রেণি। কারণ বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ছিল মুসলমান। তারা ভূমিব্যবস্থার কারণে চরমভাবে শোষিত হচ্ছিল। অত্যাচারিত হচ্ছিল জমিদার ও তাদের নায়েব-গোমস্তাদের দ্বারা। যে কারণে জমিদারদের প্রতি কৃষকরা ক্ষুব্ধ ছিল। আবার এই জমিদারদের বেশির ভাগ ছিল হিন্দু। জমিদারের অত্যাচারে অতিষ্ট অনেক দরিদ্র হিন্দু কৃষকও বঙ্গভঙ্গের সমর্থক ছিল। মুসলমান সমাজ দূরে থাকার কারণে স্বদেশী আন্দোলন জাতীয় রূপলাভে ব্যর্থ হয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বিলেতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনও সফল হয়নি। কারণ কলকাতার মাড়ওয়ারি অবাঙালি ব্যবসায়ী এবং বাংলার গ্রামগঞ্জের ব্যবসায়ীরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। সর্বোপরি এই আন্দোলন গোপন সশস্ত্র সংগ্রামের পথে অগ্রসর হলে এ আন্দোলন থেকে জনগণ দূরে সরে যায়। ফলে গণবিচ্ছিন্ন আন্দোলন সফলতার দ্বারে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। মুসলিম সমাজ এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবে আন্দোলন শক্তিশালী হতে পারেনি। সাধারণ মানুষ, এমনকি নিমড়ববর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়, দরিদ্র সমাজও এই আন্দোলনের মর্ম বোঝার চেষ্টা করেনি। ফলে আন্দোলন সর্বজনীন এবং জাতীয় রূপ লাভ করতে ব্যর্থ হয়। এর উপর চলে ইংরেজ সরকারের চরম দমননীতি, পুলিশি অত্যাচার। সবকিছু মিলে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
স্বদেশী আন্দোলনে তাৎক্ষণিক সফলতা না এলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণসচেতনতার জন্ম হয়। এ আন্দোলনই উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করে। আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রসমাজ যুক্ত হওয়ার কারণে ছাত্রদের গুরুত্ব যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনই ছাত্রসমাজ রাজনীতিসচেতন হয়ে উঠে। ভারতের পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে তাদের উপস্থিতির শুরু এখান থেকেই।
 এই আন্দোলনের আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে অর্থনৈতিক। এর ফলে দেশী শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা স্থাপনের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এদেশীয় ধনী ব্যক্তিরা কল্লকারখানা স্থাপন করতে থাকেন। যেমন: স্বদেশী তাঁত বস্ত্র, সাবান, লবণ, চিনি, কাগজ, চামড়াজাত দ্রব্য ইত্যাদির উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন স্থানে অনেক কল্লকারখানা স্থাপিত হয়। ঐ সময় আধুনিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেমন বেঙ্গল ক্যামিকেল প্রতিষ্ঠিত হয়, বিখ্যাত টাটা কোম্পানি ১৯১০ সালে টাটা কারখানা স্থাপন করেন। তাছাড়া আরো ছোটখাটো অনেক দেশি শিল্প কারখানা এই সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি বিজ্ঞান, শিক্ষা, ভাষাসাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আগ্রহ উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত, মুকন্দ দাসের বাঙালি জাতি চেতনায় সমৃদ্ধ এবং দেশাত্মবোধক গানগুলো ঐ সময় রচিত। রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের জাতীয় সংগীতটি ঐ সময় রচনা করেন। স্বদেশী আন্দোলনের হতাশার দিক হচ্ছে, এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল ধরে। নানা ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে এই তিক্ততা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে ভাঙ্গনের সূত্রপাত, স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে তা আরো তিক্ত হয়। ফলে সম্পর্কের এই ভাঙ্গন এদেশের রাজনীতি, সমাজ ও জাতীয় কর্মকাণ্ডের সকল ক্ষেত্রে সর্বাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে থাকে, যা শেষ হয় ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে।

Comments

Popular posts from this blog

অখন্ড বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দেশ ও সংগঠনের অবদান

খেলাধুলার নিয়ম কানুন (ক্রিকেট, ফুটবলের) সকল নিয়ম