বাংলা ভাষা ও সাহিত্য : উদ্ভব ও বিকাশ

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য : উদ্ভব ও বিকাশ

আর্যদের প্রাচীন বাংলায় আগমনের পূর্বে এখানে নানা জাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক বসবাস করত। তারা আর্যভাষী হিন্দু ছিল না।
 কিন্তু তারা যে কোন ভাষায় কথা বলত তা সঠিকভাবে আজও নির্ণয় করা যায়নি। গোষ্ঠী বিভাগের সঙ্গে মানব জাতির ভাষা বিভাগের সংমিশ্রণ না ঘটিয়ে একথা বলা যায় যে, বাংলার প্রাচীন অধিবাসীরা নানা ভাষা-ভাষী লোক ছিল না।
বাংলার প্রাচীনতম অধিবাসীরা সম্ভবত ছিল অস্ট্রিক গোষ্ঠীর অস্ট্রো-এশিয়াটিক জাতির মানুষ। তারা ব্রহ্মদেশে (মায়ানমার) ও শ্যামদেশের (থাইল্যান্ড) মোন এবং কম্বোজের হ্মের শাখার মানুষের আত্মীয়। এ জাতীয় মানুষকেই বোধ হয় বলা হতো ‘নিষাদ’ কিংবা ‘নাগ’; আর পরবর্তীকালে ‘কোল-’, ‘ভিল-’ ইত্যাদি। তা হলে অনুমান করা যেতে পারে যে, তাদের ভাষাও ছিল অস্ট্রিক গোষ্ঠীর মোন, হ্মের শাখার ভাষার মতোই। অনেকটা এরূপ ভাষায় এখনও কথা বলে বাংলাদেশের পশ্চিমে কোল, মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, আর বর্তমান আসাম রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের বাসিন্দারা। অস্ট্রিক গোষ্ঠী ছাড়াও বাংলায় বাস করত দ্রাবিড় গোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখার লোক। তারা ছিল সুসভ্য জাতির মানুষ। তাদের প্রধান বাসভূমি এখন দাক্ষিণাত্যে। কিন্তু এক সময় তারা সম্ভবত পশ্চিম-বাংলা ও মধ্য-বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও দ্রাবীড় ভাষার লোকেরা ছাড়াও পূর্ব ও উত্তর বাংলায় বহু পূর্বকাল হতে নানা সময়ে এসেছিল মঙ্গোলীয় বা ভোট চীনা গোষ্ঠীর নানা জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক। এরা হলো গাড়ো, বড়ো, কোচ, মেছ, কাছাড়ি, টিপরাই, চাকমা প্রভৃতি। সম্ভবত এদেরই বলা হতো কিরাত জাতি। এরা ভোটচীনা গোষ্ঠীর নানা ভাষা- উপভাষায় কথা বলত। এর কোনো কোনো শব্দ ও রচনা পদ্ধতি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত ভাষায় লুকিয়ে আছে এবং এর কিছু কিছু নিদর্শন ভাষা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পেরেছেন।
অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনা ভাষাগোষ্ঠীর পর যে নতুন একটি ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ বাংলায় প্রবেশ করে তারা হলো আর্য। আর্যদের ভাষার নাম প্রাচীন বৈদিক ভাষা। পরবর্তীকালে এ ভাষাকে সংস্কার করা হয়। পুরানো ভাষাকে সংস্কার করা হয় বলে এ ভাষার নাম হয় সংস্কৃত ভাষা। সম্ভবত বৈদিক যুগের শেষ দিকে তারা বাংলায় আগমন শুরু করে।
আর খ্রিস্টীয় প্রম শতকের মধ্যে তারা এদেশে বসতি স্থাপন শেষ করেছিল। ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো দীর্ঘদিন ধরে তারা বাংলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করতো। ফলে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিবাসীরা নিজেদের ভাষা ত্যাগ করে সম্পূর্ণভাবে আর্য ভাষা গ্রহণ করে। সুতরাং, সর্বপ্রাচীন যুগে আর্যগণ যে ভাষা ব্যবহার করত এবং যে ভাষায় বৈদিক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল স্থানভেদে এবং সময়ের পরিবর্তনে এর অনেক পরিবর্তন ঘটে। সংস্কৃত হতে প্রকৃত এবং প্রথাকৃত হতে অপভ্রংশ ভাষার উৎপত্তি হয়। অপভ্রংশ ভাষা হতে অষ্টম বা নবম শতকে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়। যেমন- কৃষ্ণ>কাহ্ন>কানু>কানাই।
নয় ও দশ শতকের আগে বাংলা ভাষার রূপ কি ছিল তা জানবার কোন উপায় নেই। তবে এ শতকগুলোতে বাংলায় সংস্কৃত ছাড়াও দুটো ভাষা প্রচলিত ছিল  এর একটি হলো শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং অন্যটি মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় গৌড়-বঙ্গীয় রূপ  যাকে বলা যায় প্রাচীনতম বাংলা ভাষা। একই লেখক এ দু ভাষাতেই পদ, দোহা, ও গীত রচনা করতেন। বাংলা ভাষার এরূপ প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপাল হতে সংগৃহীত চারটি প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথিতে। এগুলো ‘চর্যাপদ’ নামে পরিচিত। এখন পর্যন্ত মোট ৪৭টি চর্যাপদ পাওয়া গেছে। এ চর্যাপদগুলোর মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয়। পরবর্তী যুগে বাংলায় সহজিয়া গান, বাউল গান ও বৈষ্ণব পদাবলীর উৎপত্তি হয়।
সুতরাং, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের দিক থেকে এ চর্যাপদগুলোর মূল্য অপরিসীম। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, আট শতক হতে বারো শতক পর্যন্ত এ পাঁচশত বছরই হলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন যুগ।

Comments

Popular posts from this blog

অখন্ড বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

খেলাধুলার নিয়ম কানুন (ক্রিকেট, ফুটবলের) সকল নিয়ম

স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দেশ ও সংগঠনের অবদান