বিভাগ-পূর্ব বাংলার রাজনীতি (১৯৩৭-১৯৪৭)
১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যু এবং ১৯২৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এ পরিস্থিতিতে মওলানা আকরম খাঁ ও তমিজউদ্দিন খান প্রথমুখ মুসলিম নেতা কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ১৯২৯ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনের পর ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ নামে একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলার কৃষকের অবস্থার উন্নতি সাধন করা। ফলে কৃষক আন্দোলন ও রাজনীতিতে নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত প্রজা সমিতির সম্মেলনে এ.কে. ফজলুল হক নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তী বছরে এর নতুন নামকরণ হয় ‘কৃষক প্রজা পার্টি’। কৃষক প্রজা পার্টি ছিল সম্পূর্ণভাবে পৃক এবং প্রদেশ পর্যায়ে গঠিত বাংলার রাজনৈতিক সংগঠন। ১৯৩৭ সালে মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের মধ্যে। তবে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করার যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে মুসলিম লীগ ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং শিক্ষামন্ত্রির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সম্মিলিত মন্ত্রিসভা ছিল দুর্বল। ফলে কৃষক প্রজা পার্টি দুর্বল হয়ে পড়ে। জিন্নাহর সাথে ফজলুল হকের মতবিরোধের কারণে ১৯৪১ সালে ফজলুল হক মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন ফজলুল হকের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন থাকায় ঐ সালের ডিসেম্বর মাসেই তিনি দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ নতুন মন্ত্রিসভা ছিল বহুদলের সমাবেশ। এরূপ একটি মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে ফজলুল হক বাংলার রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সূচনা করেন। এই নতুন ধারা ছিল বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করা। ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল। ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন না পেয়ে ফজলুল হক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৪৩ সালের ১৩ এপ্রিল দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে খাজা নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। সর্বনাশা এ দুর্ভিক্ষে বাংলার ৩০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে বলে ধারণা করা হয়। ১৯৪৫ সালে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে বাংলার মুসলিম লীগ দুটি উপদলে বিভক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী বাংলার মুসলিম লীগের নেতা নির্বাচিত হন। নির্বাচনে মুসলিম লীগ ১১৪ আসনে জয়লাভ করে। যা প্রকারান্তের পাকিস্তান দাবির প্রতি বাংলার মুসলমানদের সুস্পষ্ট সমর্থনের প্রতিফলন ঘটায়। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এ নির্বাচন ও নির্বাচনের ফল ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৬ সালে ২৪ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। প্রকৃত পক্ষে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সময়কাল ছিল বাংলা ও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্রান্তিলগড়ব। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও দেশ বিভাগের রাজনৈতিক পরিবেশে কলকাতার দাঙ্গা ও স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও ভারত বিভাগ ছিল এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

Comments
Post a Comment
Thanks for your comment