যুক্তফ্রন্ট এবং প্রদেশিক নির্বাচন (১৯৫৪)

যুক্তফ্রন্ট এবং প্রদেশিক নির্বাচন (১৯৫৪)

১৯৫৪ সালের নির্বাচন ও যুক্তফ্রন্ট গঠন ছিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মূলত এ নির্বাচন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিম লীগ শাসক ও তার দোসরদের শোষণের বিরুদ্ধে এক ‘ব্যালট বিপ্লব’। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিভিন্ন উপদল, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্যর্থ শাসন, অঞ্চলভেদে বৈষম্যমূলক নীতি প্রভৃতির কারণে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন আবশ্যক করে তোলে। বিশেষ করে এ সময় পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ শাসনের চরম ব্যর্থতার ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, নেজাম-ই-ইসলামী, পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। পূর্ব থেকেই ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রথাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও মুসলিম লীগ সরকার পরাজয়ের আশঙ্কায় নানা টালবাহানা করে নির্বাচনের তারিখ বারবার পিছিয়ে দেয়। অবশেষে সরকার পূর্ব বাংলায় প্রথাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ধার্য করে ১৯৫৫ সালের ৮ মার্চ।
 যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভুমি এবং ২১ দফা কর্মসূচি
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুসলিম লীগ ছিল পুরাতন ও বড় দল। এছাড়া পূর্ববাংলার প্রথাদেশিক সরকার পরিচালনা করত মুসলিম লীগ। ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিম লীগকে পরাজিত করার কৌশল হিসেবে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। যুক্তফ্রন্ট মূলত চারটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়।  মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, শেরেবাংলা ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক পার্টি, মওলানা আতাহার আলীর নেজাম-ই-ইসলামী পার্টি এবং হাজী দানেশের বামপন্থী গণতন্ত্রী দল। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল ‘নৌকা’। আওয়ামী মুসলিম লীগের নির্বাচনী কর্মসূচির ৪২ দফার প্রধান প্রধান দাবি নিয়ে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। পূর্ব বাংলার গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে সামনে রেখে রচিত এই ২১ দফা কর্মসূচির মুখ্য রচয়িতা ছিলেন আবুল মনসুর আহমেদ। এই দফাগুলো সংক্ষেপে বর্ণিত হলো:
১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
২. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ।
৩. পাটশিল্পের জাতীয়করণ করা।
৪. কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তন।
৫. লবণের কারখানা স্থাপন।
৬. মোহাজের-শিল্পী-কারিগর শ্রেণির কর্মসংস্থান।
৭. খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের অবসান করা।
৮. শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা।
৯. অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রথাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন।
১০. মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করা এবং সকল বিদ্যালয়কে সরকারি সাহায্য করা।
১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।
১২. শাসন ব্যয় হ্রাস করা। মন্ত্রীর বেতন এক হাজারের বেশি না হওয়া।
১৩. ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
১৪. জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কলাকানুন রদ।
১৫. বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃক করা।
১৬. মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ‘বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা গবেষণাগারে পরিণত করা।
১৭. ৫২’-এর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ।
১৮. ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা।
১৯. ১৯৪০ -এর লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান।
২০. আইন পরিষদের মেয়াদ কোনোভাবেই বৃদ্ধি করা হবে না।
২১. আইন পরিষদের আসন শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে উপ নির্বাচন দিয়ে তা পূরণ করা।
 নির্বাচনের ফলাফল
১৯৫৪ সালের ৮ মার্চের নির্বাচন ছিল পূর্ব বাংলায় প্রথম অবাধ ও সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন।নির্বাচনে শতকরা ৩৭.১৯ ভাগ ভোটার ভোট দেয়। ২ এপ্রিল সরকারিভাবে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়। মোট ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন, পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস ২৪টি, তফসিলি ফেডারেশন ২৭টি, খেলাফতে রব্বানী ২টি, খ্রিস্টান ১টি, বৌদ্ধ ১টি, কম্যুনিস্ট পার্টি ৪টি আসন লাভ করে।
নির্বাচনের তাৎপর্য
১৯৫৪ সালের নির্বাচন ছিল মুসলিম লীগের অন্যায়, বৈষম্যমূলক, ব্যর্থ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ। বাঙালি জাতি এ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগকে বুঝিয়ে দেয় যে তারা পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগকে আর চায় না।যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে তরুণ নেতৃত্বের জনপ্রিয়তা পূর্ব বাংলার ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরির পথ সুগম করে। কারণ অনেক তরুণ নেতার কাছে মুসলিম লীগের বড় বড় নেতৃত্বের পরাজয় ঘটে। এছাড়া যুক্তফ্রন্টের মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগের সর্বোচ্চ আসন লাভ ভবিষ্যতে তাদের পূর্ব বাংলায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত বহন করে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ ধারার সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি এ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ ও অবাঙালি নেতৃত্বের প্রতি বাঙালির মনে ব্যাপক অনাস্থা জন্মায়। তারা বুঝতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা বাঙালির প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাবাসী স্বায়ত্তশাসনের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে।
 নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
 যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠন
শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের ১৪ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও অর্থ, রাজস্বও স্বরাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্ব নেন। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আবু হোসেন সরকার বিচার, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক শিক্ষা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, সমবায় ও পল-ী উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব লাভ করেন।
যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা বাতিল ও পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন
যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ জয় শুরু থেকেই মুসলিম লীগ সুনজরে দেখেনি। তারা যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে। এ সময় শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক কলকাতা সফরে দুই বাংলা নিয়ে আবেগপ্রবণ বক্তব্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরাগভাজন হন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারী ছুটি ও বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দিলে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় সরকার সুযোগ খুঁজতে থাকে যেকোনো অজুহাতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করতে। এমতাবস্থায় মে মাসে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে কারা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় জনগণের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং আদমজী জুট মিলে বাঙালি ও বিহারী শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক গোলযোগ হয়। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ বলে দায়ী করতে থাকে। একই সময় ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ ফজলুল হকের এক সাক্ষাৎকার বিকৃত করে প্রকাশিত হয় যে তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চান। এতে মুসলিম লীগ সরকার তাঁকে রাষ্ট্রোদ্রোহী বলে ঘোষণা দেয়। অবশেষে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারা বলে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করে। এ শাসন ১৯৫৫ সালের ২ জুন পর্যন্ত বহাল থাকে। মাত্র ৫৬ দিনের শাসনের পর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অবসান হয়। মূলত মুসলীম লীগ ও পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে এবং যুক্তফ্রন্টের শরিক দলের মধ্যে কোন্দলের কারণে ঘন ঘন সরকার বদল হতে থাকে। মাত্র চার বছরে সাত মন্ত্রিসভার পতন হয়। কেন্দ্রিয় সরকার তিনবার গভর্নরের শাসন জারি করে। যুক্তফ্রন্টের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও কেন্দ্রিয় সরকারের চক্রান্তের ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি।
 ১৯৫৬ সালের সংবিধান
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে দ্রুত সংবিধান রচনার দাবি উঠে। পূর্ব বাংলা থেকে এ দাবি ছিল আরও জোরালো। পূর্ব বাংলার জনদাবিই ছিল নতুন সংবিধানের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার প্রথাদেশিক স্বায়ত্তশাসন যেন অর্জিত হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করতে চাইল। প্রথম অবস্থায় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পাকিস্তান গণপরিষদ গঠন করা হয়। এই গণপরিষদের দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবে কাজ করা এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর অনিহায় গণপরিষদের কাজ ব্যহত হতে থাকে। অবশেষে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ কর্তৃক একটি মূলনীতি কমিটি গঠনকরা হয়। এ মূলনীতি কমিটিতে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিছিল নগণ্য। নানা কালক্ষেপণ করে মূলনীতি কমিটি ১৮ মাস পরে তার সুপারিশ ও প্রতিবেদন পেশ করে। এ কমিটির সুপারিশে পূর্ব বাংলার জনগণকে সবদিক থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক প্রতিবাদ উঠে এবং তারা কমিটির সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করে। এরপর মূলনীতি কমিটি ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় এবং ১৯৫৩ সালে তৃতীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে যায়। অবশেষে ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে গভর্নর জেনারেল পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। পশ্চিম ও পূর্ব অংশের নেতারা একটি সমঝোতায় আসতে সক্ষম হন। তারই ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধান রচিত হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর চালু ছিল মাত্র দু বছর। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে সংবিধান স্থগিত করা হয় এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তানে সাংবিধানিক শাসনের অবসান ঘটে।

Comments

Popular posts from this blog

অখন্ড বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দেশ ও সংগঠনের অবদান

খেলাধুলার নিয়ম কানুন (ক্রিকেট, ফুটবলের) সকল নিয়ম