১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান

১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান


১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন দানা বাঁধে তা একসময় ছাত্রসমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়ে শহর ও গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষের মাঝে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠে এক দুর্বার আন্দোলন, যা ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আইয়ুব খানের পতনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষ প্রমবারের মতো একসাথে আন্দোলনে নামে এবং আইয়ুব খানের পতনের মাধ্যমে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি জাতিগত নিপীড়ন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬০-এর দশকের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টিতে সেগুলো প্রত্যক্ষ প্রভাব রেখেছিল। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালের সবচেয়ে বড় আন্দোলন। ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসের ছাত্র অসন্তোষ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। ৬ ডিসেম্বর ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালনের জন্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন ও পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি যৌথ কর্মসূচি হিসাবে পল্টন ময়দানে একটি জনসভার আয়োজন করে। জনসভার পর একটি বিরাট মিছিল গভর্নর হাউস ঘেরাও করে। সেখানে মিছিলকারীদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হলে মওলানা ভাসানী ঢাকা শহরে হরতাল আহ্বান করেন। ৮ ডিসেম্বর প্রধান বিরোধী দলগুলোর ডাকে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ‘নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে। ২৯ ডিসেম্বর ঘেরাও আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়রি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া ও মেনন গ্রুপ), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃবৃন্দরা মিলে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার সাথে মিলিয়ে আরও কয়েকটি দাবি নিয়ে ১১ দফা দাবি পেশ করে। অচিরেই ১১ দফা দাবিকে আপামর বাঙালি সমর্থন প্রদান করে।
ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ে ছাত্র সংগ্রামের এই ১১ দফা দাবি ছিল খুবই সময়োপযোগী। ফলে দ্রুত এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের ৮টি রাজনৈতিক দল মিলে ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ’ (ডাক) নামক মোর্চা গঠন করে এবং ৮ দফা দাবি পেশ করে।এরপর থেকে ‘ডাক’ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যৌথ উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে উঠে। ডাক-এর আহ্বানে ১৪ জানুয়ারি সমগ্র পাকিস্তানের হরতাল পালিত হয়। ১৮ জানুয়ারি পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট পালন করে। ধর্মঘট চলাকালীন পুলিশের সাথে ছাত্রদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ২০ জানুয়ারি নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালন করে। হরতাল পালনকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আসাদের হত্যার প্রতিবাদে ২২, ২৩ ও ২৪ তারিখে ব্যাপক কর্মসূচি ঘোষিত হয়। ২৪ তারিখে সারা দেশে হরতাল চলাকালে সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক ঢল নামে। সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে আন্দোলন যেন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আবারও পুলিশের গুলিতে নবম শ্রেণীর ছাত্র কিশোর মতিউর নিহত হয় এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়। এরপর ক্ষিপ্ত জনতা সরকারি পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঢাকা সরকারের নিয়ন্ত্রের বাইরে চলে যায়। ২৪ জানুয়ারির পর থেকে লাগাতার আন্দোলন ও হরতালে বহুসংখ্যক মানুষ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত ও আহত হয়।
১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। জহুরুল হকের হত্যার প্রতিবাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। জনতা আগরতলা মামলার বিচারপতির বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিকেলে এক জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘোষণা দেন, ‘দুমাসের মধ্যে ১১ দফা বাস্তবায়ন ও রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। প্রয়োজন হলে ফরাসি বিপ্লবের মতো জেল ভেঙে মুজিবকে মুক্ত করে আনব।’ অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার ঢাকায় কারফিউ জারি করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে।
১৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আন্দোলন আরও বেগবান হলে দেশের পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। অবশেষে আইয়ুব খান বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করলে নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। আইয়ুব খান বুঝতে পারেন, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও অভিযুক্তদের মুক্তি না দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রের বাইরে চলে যাবে। গণঅভ্যূত্থানে  চাপে তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দেন, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি আর প্রার্থী হবেন না। ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পর ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন নতুন রূপ লাভ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারির সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু ১১ দফা দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং ছয় দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নে বলিষ্ঠ প্রতিশ্রুতি দেন। ২৬ ফেবুয়ারি আইয়ুব খানের সাথে গোলটেবিল বৈঠকে ছয় দফা ও ১১ দফার প্রশ্নে অটল থাকেন। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা বারবার ব্যর্থ হতে থাকে। পুরো দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থির অবনতি ঘটে। মার্চ মাসে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৯০ জন নিহত হয়। অবশেষে ১০ মার্চের বৈঠকে আইয়ুব খান সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন ও প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। ২২ মার্চ আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে অপসারণ করেন। তাতেও গণ-আন্দোলন শান্ত না হয়ে আরও দুর্বার রূপ নেয়। ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান সফলতা অর্জন করে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে গ্রাম ও শহরের কৃষক ও শ্রমিকদের মাঝে শ্রেণী চেতনার উন্মেষ ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিপূর্ণতা লাভ করে, যাতে বলীয়ান হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে।

Comments

Popular posts from this blog

অখন্ড বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দেশ ও সংগঠনের অবদান

খেলাধুলার নিয়ম কানুন (ক্রিকেট, ফুটবলের) সকল নিয়ম