স্বরাজ ও বেঙ্গল প্যাক্ট
১৯২২ খ্রিঃ মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে কংগ্রেসের অনেক নেতা কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। এ সময় মুক্তিপ্রাপ্ত নেতা চিত্তরঞ্জন দাস (সি.আর. দাস) ও মতিলাল নেহরুর সঙ্গে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের কর্মপন্থা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। সি. আর. দাস ও তাঁর সমর্থকরা নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপক পরিষদগুলোতে যোগদানের পক্ষে ছিলেন। কারণ ঐ সময় অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণে আইন অমান্য আন্দোলনের পরিবশে না থাকায় তাঁরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাছাড়া তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল আইনসভায় যোগ দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯১৯ খ্রিঃ সংস্কার আইন অচল করে দেওয়া। কিন্তু কংগ্রেসের গোয়া সম্মেলনে তাঁদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসের একাংশের সমর্থনে সি.আর. দাসের নেতৃত্বে গঠিত হয় স্বরাজ পার্টি। সি.আর. দাস হন এ দলের সভাপতি। মতিলাল নেহরু হন অন্যতম সম্পাদক। কংগেসের অভ্যন্তরে যারা স্বরাজ লাভের জন্য স্বরাজ পার্টির সমর্থক ছিলেন, তাদেরকে পরিবর্তনপন্থী এবং যারা স্বরাজ পার্টির বিপক্ষে অংশ নেয় তাদের বলা হয় পরিবর্তনবিরোধী। এই দুই পক্ষের সঙ্গে শুধু আন্দোলনের পন্থা নির্ধারণের ধরন ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কোনো বিরোধ ছিল না। স্বরাজ দলের বিরোধীরা অসহযোগ আন্দোলনের ধারা বজায় রেখে আইন বয়কট করার সিদ্ধান্তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে। অপর দিকে স্বরাজ দল গঠনের পরপর বাংলার অনেক বিপ্লবীÑ সুভাষচন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অনেক যুবনেতা এতে যোগদান করেন।
স্বরাজ দলের কর্মসূচি :
এক. আইনসভায় প্রবেশ করে সরকারি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করা এবং ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত সংস্কার আইন অকার্যকর করে দেয়া;
দুই. সরকারি বাজেট প্রত্যাখ্যান করা এবং মন্ত্রিসভার পতন ঘটানো;
তিন. বিভিন্ন প্রস্তাব ও বিল উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও কর্মকাণ্ডকে জোরদার করা এবং
চার. বিদেশি শাসনকে অসম্ভব করে তোলা।
স্বরাজ দলের কার্যাবলি : ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন অনুযায়ী, ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্বরাজ দল তাদের কর্মসূচি অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। বিশেষ করে বাংলা ও মধ্য প্রদেশে স্বরাজ দল এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুসলমানদের সমর্থন লাভের কারণে আইন সভায় স্বরাজ দলের ভিত শক্ত হয় এবং কর্মসূচি অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। বাংলায় স্বরাজ দলের অভূতপূর্ব বিজয়ের কৃতিত্ব ছিল দলের সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাসের। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, উদারনীতি বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন তাঁকে এবং তাঁর দলকে শক্তিশালী করে তোলে।
বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি (ডিসেম্বর, ১৯২৩ খ্রিঃ)
উপমহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন স্বরাজ দলের নেতা চিত্তরঞ্জন দাস। ফলে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সমস্যা দূর করার জন্য এই দূরদর্শী, বাস্তববাদী নেতা যে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, ইতিহাসে তা বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি নামে খ্যাত। এই সময়ে বাংলার ইতিহাসে প্রধান ঘটনাই ছিল বেঙ্গল প্যাক্ট। নিঃসন্দেহে তাঁর এই প্রচেষ্টা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ প্রশস্ত করেছিল। সি.আর. দাস ফর্মুলা নামে খ্যাত বাংলা চুক্তি সম্পাদনা করতে যেসব মুসলমান নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন আব্দুল করিম, মুজিবুর রহমান, আকরম খান, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। এছাড়া স্যার আব্দুর রহিম, একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমঝোতা চুক্তি সম্পাদনে সহযোগিতা ও এতে স্বাক্ষর প্রদান করেন। অপরদিকে বাংলার কংগ্রেস নেতা সুভাষচন্দ্র বসু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তাঁদের সম্মিলিত উদ্যোগে বেঙ্গল প্যাক্ট আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে মুসলমানদের বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করার শর্তই ছিল মূল বিষয়। যেমন:
এক. স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলার প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ অধিকার পাবে। লোকসংখ্যার অনুপাতে এ স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রায় বাংলাদেশ ব্যবস্থাপক পরিষদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হবে।
দুই : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রত্যেক জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় শতকরা ৬০টি আসন পাবে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শতকরা ৪০টি আসন পাবে।
তিন. সরকারি দপ্তরে মুসলমানদের জন্য শতকরা ৫৫ ভাগ চাকরি সংরক্ষিত থাকবে।
চার. কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয়ে আইন পাস করতে হলে আসনসভায় নির্বাচিত উক্ত সম্প্রদায়ের তিন-চতুর্ াংশ সদস্যের সমর্থন থাকতে হবে।
পাঁচ. মসজিদের সামনে গান-বাজনাসহ কোনো মিছিল করা যাবে না এবং গরু জবাই করার ব্যাপারে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা হবে না।
বেঙ্গল প্যাক্টের অবসান
বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সমাজে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের দলিল ছিল বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি। এই চুক্তির কারণেই মুসলমানের আস্থা অর্জন করে স্বরাজ পার্টি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে সক্ষম হয়। অপরদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতার ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন এবং মুসলমানরা কর্পোরেশনে চাকরি লাভে সক্ষম হয়। বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সি.আর দাসের এই পদক্ষেপ যেমন বাস্তবধর্মী ছিল, তেমন ছিল, প্রসংশনীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে থাকতেই হিন্দু পত্রিকাগুলো, রক্ষণশীল হিন্দু-সমাজ, গান্ধীজির সমর্থক কংগ্রেস দল ও স্বরাজ দলবিরোধী হিন্দুরা ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’- এর তীব্র বিরোধিতা করে। অপরদিকে, হিন্দু মহাসভার ‘শুদ্ধি’ ও ‘সংগঠন’ নামক আন্দোলন এবং মুসলমানদের ‘তাবলিগ’ ও ‘তানজিম’ নামক আন্দোলন সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে। ১৯২৫ খ্রিঃ ১৬ জুন চিত্তরঞ্জন দাসের অকালমৃত্যুতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া কংগ্রেস এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ‘বেঙ্গল প্যাক্ট-এর বিষয়ে উদাসীন থাকে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৬ খ্রিঃ কলকাতা এবং পরে ঢাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্প্রীতি নষ্ট হলে এই চুক্তি বাস্তবায়নের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

Comments
Post a Comment
Thanks for your comment