১৯৪৭ সালে বাংলার বিদ্যমান রাজনৈতিক ভাবাদর্শ
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় পূর্ব বাংলায় প্রধানত তিনটি রাজনৈতিক দল বা ধারা বিদ্যমান ছিল।
১. ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম লীগ,
২. অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক ধারার দল জাতীয় কংগ্রেস,
৩. বিপ্লবী সাম্যবাদী ধারার কমিউনিস্ট পার্টি।
মুসলিম লীগ ও তার অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের পর নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নতুন নামকরণ হয় পাকিস্তান মুসলিম লীগ। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসক দল হিসেবে মুসলিম লীগের যাত্রা শুরু। শুরু থেকেই উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবর্গের পকেট দলে পরিণত হয় মুসলিম লীগ। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে বাঙালি নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ওআত্মত্যাগ ভুলে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিম লীগ নেতারা বাঙালির বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে, বাঙালির প্রতি চালায় দমননীতি। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমদের মতো মুসলিম লীগের ত্যাগী বাঙালি নেতারা উপেক্ষিত হন। শাসকদল হিসেবে মুসলিম লীগ শুরু থেকেই অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিকভাবে দেশ পরিচালনা করতে থাকে। ধীরে ধীরে মুসলিম লীগ জনবিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। ১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব বাংলায় শুরু থেকেই মুসলিম লীগ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। দ্বিমুখী ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে এসময় দলটি। একটি ধারা ছিল সোহরাওয়াদী-হাশিমপন্থী, অন্যটি ছিল খাজা নাজিমুদ্দীন-আকরাম খাঁ পন্থী। প্রথম ধারাটি ছিল উদার, গণতান্ত্রিক, সংস্কারপন্থী এবং দ্বিতীয় ধারাটি ছিল রক্ষণশীল পশ্চিম পাকিস্তানিদের আজ্ঞাবহ দোসর। ফলে এ অন্তঃকোন্দল দলটিকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংস্কারপন্থী ধারার নেতাদের সবসময় কোণঠাসা, অবদমন করার চেষ্টা করত। মুসলিম লীগের চরম ভ্রান্তনীতির কারণে দেশে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলার উন্নতির দিকে সামান্যতম দৃষ্টিপাত করত না। পূর্ব বাংলার প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ ক্রমেই প্রকট হতে থাকে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ছিল লক্ষণীয়। ১৯৪৮ সাল থেকে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের জনসমর্থন অতি দ্রুত কমতে থাকে।
নতুন নতুন রাজনৈতিক দল
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক আচরণ, দমননীতি, পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সীমাহীন বৈষম্য, বাংলা ভাষার অবমাননা ইত্যাদি কারণে মুসলিম লীগের অনেক নেতা মর্মাহত হন। মুসলিম লীগের বিরোধী পক্ষরা রাজনৈতিক দল গঠনে এগিয়ে আসেন। এসময় পূর্বের কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও পিপলস ফ্রিডম লীগ, গণ আজাদী লীগ, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, নেজামে ইসলাম, খিলাফত-ই-রাব্বানী পার্টি, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ইত্যাদি সংগঠন গড়ে উঠে। তবে সবচেয়ে বড় পটপরিবর্তন ছিল খোদ মুসলিম লীগের মধ্যে ভাঙন। বাংলার মুসলিম লীগের সংস্কারপন্থী নেতারা মুসলিম লীগ ত্যাগ করে গড়ে তোলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলায় মুসলিম লীগবিরোধী এক বা একাধিক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠে।
আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ
দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম লীগের এক অংশ যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সংস্কারপন্থী ছিল, তাদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি মদদপুষ্ট অপর অংশ নানাভাবে দমন, নিপীড়ন চালাতে থাকে। দেশ শাসনে চরম ব্যর্থতার পরিচয়ে দিয়ে এই অংশ জনগণ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে। অন্যদিকে মুসলিম লীগের বঞ্চিত নেতাদের প্রতি জনসমর্থন বাড়ে। জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুসলিম লীগের প্রচলিত নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী একটি বিরোধী দল গঠনের জন্য আলোচনায় বসেন। এরই ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগবিরোধী নেতৃবৃন্দের সাথেও নতুন দল গঠন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। নতুন দল গঠনের তৎপরতা ও প্রস্তুতির পর ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে কর্মী সম্মেলন হয়। ৩০০ জন শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধি এতে অংশ নেন। সভায় সর্বসম্মতভাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ২৪ জুন সদ্য গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার আরমানিটোলায়। জন্মলগড়ব থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগ দলটি প্রথাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ সময়ে তাদের প্রধান দাবির মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, একজনের এক ভোট, গণতন্ত্র, একটি সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ। বাংলার ইতিহাসে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রথম সফল বিরোধী দল। এ দলটি গঠনের মাধ্যমে বিরোধী রাজনীতিতে যে শূন্যতা ছিল তা পূরণ হয়। মুসলিম লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কুশাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে অচিরেই দলটি জনগণের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়। দলটি পরবর্তী ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠন ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ জয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এরপর মুসলিম লীগ একটি নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয়।
জন্ম থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগ অসম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী ছিল। ফলে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নাম ধারণ করে এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য এর দ্বার খুলে দেওয়া হয়। ১৯৬৬ সালে ‘ছয় দফা’ দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রকৃতই আওয়ামী বা জনগণের দলে পরিণত হয়। এর পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই আওয়ামী লীগের হাতে চলে আসে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে দলটির সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ জনগণের ব্যাপক আস্থার পরিচয় দেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

Comments
Post a Comment
Thanks for your comment