প্রাচীন বাংলার আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব ও রীতি-নীতি
প্রাচীন বাংলায় পূজা-পার্বন ও আমোদ প্রমোদের প্রচুর ব্যবস্থা ছিল। উমা অর্থাৎ দূর্গার অর্চনা উপলক্ষে বরেন্দ্রে বিপুল উৎসব হতো। বিজয়া দশমীর দিন ‘শাবোরৎসব’ নামে একপ্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হতো। চৈত্র মাসে বাদ্য সহকারে এক ধরনের অশ্লীল গানের রীতি তখন প্রচলিত ছিল। হোলাকা বা বর্তমান কালের ‘হোলি’ একটি প্রধান উৎসব ছিল। স্ত্রী-পুরুষ সকলে এতে যোগদান করতো। কোজাগরী পূর্ণিমা রাত্রিতে অক্ষ-ক্রীড়া হতো। আত্মীয়-স্বজন মিলে চিড়া ও নারকেলের প্রস্তুত নানাবিধ খাদ্য গ্রহণ সে রাত্রির প্রধান অঙ্গ ছিল। দ্যুত-পতিপদ নামে একটি বিশেষ উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদে অনুষ্ঠিত হতো। এ মাসেই সুখরাত্রিব্রত পালিত হতো। ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, আকাশপ্রদীপ, জন্মাষ্টমী, অক্ষয় তৃতীয়া, দশহরা, গঙ্গাস্নান, মহাঅষ্টমীতে ব্রহ্মপুত্র স্নান ইত্যাদি বর্তমানের সুপরিচিত অনুষ্ঠানগুলো সেকালেও প্রচলিত ছিল।
এ সকল পূজা-পার্বণে অনুষ্ঠিত নানাবিধ আমোদ-উৎসব ব্যতীত হিন্দুধর্মের অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানও প্রাচীনকালের সামাজিক জীবনে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। শিশুর জন্মের পূর্বে তার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন ও শোষ্যন্তীহোম অনুষ্ঠিত হতো। জন্মের পর জাতকর্ম, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, পৌষ্টিককর্ম, অন্নপ্রথাশন ও আরও অনেক উপাচার পালন করা হতো।
বাংলার হিন্দুদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মশাস্ত্রের প্রবল প্রভাব ছিল। কোন্ তিথিতে কি কি খাদ্য ও কর্ম নিষিদ্ধ, কোন্ তিথিতে উপবাস করতে হবে এবং বিবাহ, অধ্যয়ন, বিদেশ যাত্রা, তীর্থ গমন প্রভৃতির জন্য কোন্ কোন্ কাল শুভ বা অশুভ সে বিষয়ে শাস্ত্রের অনুশাসন কঠোরভাবে পালিত হতো।
তখনকার দিনে বাঙালি পুরুষদের কোনো সুনাম ছিল না। বরং তারা বিবাদপ্রিয় ও উদ্ধত বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু বাঙালি মেয়েদের সুখ্যাতি ছিল। মেয়েরা লেখাপড়াও শিখত। শিক্ষিত সমাজে মাতা ও পত্নবীর সম্মান ও মর্যাদা বেশ উচ্চ ছিল। সে যুগে অবরোধ বা পর্দা প্রথা ছিল না। বাংলার মেয়েদের কোনো স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা ছিল না। একটি মাত্র স্ত্রী গ্রহণই ছিল সাধারণ নিয়ম। তবে পুরুষের মধ্যে বহু বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। অনেক স্ত্রীকেই সপত্নবীর সঙ্গে একত্রে জীবন যাপন করতে হত। বিধবা নারী জীবনের চরম অভিশাপ বলে বিবেচিত হত। মুছে যেত কপালের সিঁদুর এবং সেই সঙ্গে তার সমস্ত প্রসাধন ও অলঙ্কার। বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাস বর্জন ও কৃচ্ছ্র সাধন করতে হতো। সহমরণ প্রথা সেকালেও প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যু হলে একই চিতায় স্ত্রীকেও জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। প্রাচীন বাংলায় ধন-সম্পত্তিতে নারীদের কোনো বিধিবিধানগত অধিকার ছিল না। তবে, স্বামীর অবর্তমানে অপুত্রক বিধবা স্ত্রী স্বামীর সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দাবি করতে পারত।
বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে নৈতিক জীবনের খুব উচ্চ আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। একদিকে সত্য, শৌচ, দয়া, দান প্রভৃতি সর্ববিধ গুণের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। অপরদিকে, ব্রহ্ম হত্যা, সুরা পান, চুরি করা, পরদার গমন (পরস্ত্রীর নিকট গমন) প্রভৃতি মহাপাতক বলে গণ্য করে তার জন্য কঠোর শাস্তি ও গুরুতর প্রথায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনে এ আদর্শ কি পরিমাণে অনুসরণ করা হতো তা বলা কঠিন। তবে সমাজ জীবনে কিছু কিছু দুর্নীতি ও অশ্লীলতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

Comments
Post a Comment
Thanks for your comment