ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য), ১৯৬৮
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনমানুষের সাথে অধিক সম্পৃক্ততা তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের জননেতায় পরিণত করেছিল। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড রুদ্ধ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বারবার তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে। তারপরও বঙ্গবন্ধুকে এ ভূখণ্ডকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টা থেকে রিবত রাখা যায়নি। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে নানা পেশার, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর তরুণ বাঙালি সদস্যদের যোগাযোগ হয়। একপর্যায়ে তিনি সশস্ত্র বিপ-বের দিকে আকৃষ্ট হন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন একদল সেনাসদস্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। তাঁদের সাথে বঙ্গবন্ধুর সশস্ত্র আন্দোলন নিয়ে মতবিনিময় হয়। ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু গোপনে ত্রিপুরা গমন করেন। সেখানে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও পরবর্তীকালে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের সাথে তাঁর বৈঠক হয়। সেখানে তিনি শচীন্দ্রলালের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে বার্তা পাঠিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে সহযোগিতা কামনা করেন। উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন জনমানুষের দাবিতে পরিণত হয়। এদিকে সামারিক বাহিনীতে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে কয়েকজন বাঙালি অফিসার ও সেনাসদস্য গোপনে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য সংগঠিত হতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে।
সারা পাকিস্তানে দেড় হাজার বাঙালিকে গ্রেফতার করা হয়। এ ষড়যন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। তখন বঙ্গবন্ধু জেলে বন্দী ছিলেন। এ মামলাটি দায়ের করা হয় ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলাতে ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক হয়। সেখানে ভারতের সহায়তায় সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করা হয়। এ জন্য মামলাটির নাম হয় ‘আগরতলা মামলা’। সরকারি নথিতে মামলার নাম হলো ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’।
১৯৬৬ সালের ৯ মে জেলে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে সামরিক আইনে জেলগেট থেকে আবার গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। এ মামলায় ৩৫ জন অভিযুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে অন্য ৩৪ জন অভিযুক্ত ছিলেন লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, এল.এস. সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ, নূর মোহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ, এ.বি.এম. আবদুস সামাদ, হাবিলদার দলিল উদ্দিন হাওলাদার, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, ভূপতি ভূষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী), বিধান কৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, হাবিলদার মুজিবুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, এ.বি.এম. খুরশীদ, খান শামসুর রহমান সিএসপি, রিসালদার এ.কে.এম. শাসসুল হক, হাবিলদার আজিজুল হক, মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট সামসুল হক, মেজর ডা. শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মো. আবদুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন শওকত আলী, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা, ক্যাপ্টেন এ.এস.এম. নুরুজ্জামান, ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুল জলিল, মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট এম.এম.এম. রহমান, সুবেদার এ.কে.এম. তাজুল ইসলাম, মো. আলী রেজা, ক্যাপ্টেন ডা. খুরশীদ উদ্দিন আহম্মেদ ও লেফটেন্যান্ট আবদুর রউফ।
আগরতলা মামলার বিচারকার্য পরিচালনার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন বেলা এগারোটায় কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের একটি বিশেষ কক্ষে মামলার শুনানি শুরু হয়। সাক্ষীর সংখ্যা ছিল সরকার পক্ষে ১১ জন রাজসাক্ষীসহ মোট ২২৭ জন। প্রখ্যাত আইনজীবী আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে অভিযুক্তদের আইনজীবীদের নিয়ে একটি ডিফেন্স টিম গঠন করা হয়। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালিরা ব্রিটেনের প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়াম এমপিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী হিসেবে প্রেরণ করে। পাকিস্তান সরকারের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদের ও অ্যাডভোকেট জেনারেল টি. এইচ. খান। ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এস এ রহমান। অপর দুই বিচারপতি ছিলেন এম আর খান ও মুকসুমুল হাকিম। ২৯ জুলাই ১৯৬৮ মামলার শুনানি পুনরায় শুরু হয়। স্যার টমাস উইলিয়াম ৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করেন। বিচারকার্য চলার সময় পাকিস্তানের উভয় অংশে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জোরদার হয়। ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানের গণ-বিক্ষোভ ১৯৬৯ সালে এসে গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এরই মধ্যে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশ হয়ে পড়লে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ঢাকাবাসী প্রচণ্ড ক্রোধে গর্জে উঠে। তাঁর মৃতদেহ নিয়ে জনতা রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। ৬৯’এর গণ-অভ্যুত্থানে সারা পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠে। পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ রাওয়ালপিণ্ডিতে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করেন। সেখানে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠকে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত ছিলেন। আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুর যোগদানের জন্য তাঁকে প্যারলে মুক্তিদানের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মওলানা ভাসানীসহ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সরকারি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দাবি করে পুরো আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করার। অবশেষে আইয়ুব সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে নতিস্বীকার করে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। বঙ্গবন্ধুসহ মামলার সকল অভিযুক্ত ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ মুক্তি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি উপলক্ষে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ রেসকোর্স ময়দানে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেই বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
আগরতলা মামলার গুরুত্ব :
বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণে এই মামলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যে উদ্দেশ্যে আইয়ুব সরকার আগরতলা মামলা দায়ের করেছিল তা আদৌ সফল হয়নি, বরং এটি আইয়ুব সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। এ সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী এগিয়ে আসেন এবং বাঙালি স্বার্থের মুখপাত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশেড়ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে স্বীকৃত হয়।
১১ দফা আন্দোলন
১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। এ ব্যাপক গণ-আন্দোলনে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হলে আন্দোলনের গতি কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ছাত্ররা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, যা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ) কার্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া ও মেনন গ্রুপ) এবং ডাকসুর যৌথ উদ্যোগে ডাকসুর তৎকালীন সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন কর হয়। এ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের ডাক দেয়। এ কর্মসূচি অচিরেই শুধু ছাত্রদের নয়, বরং আপামর জনগণের আন্দোলনে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। ১১ দফা দাবির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দাবির মধ্যে ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কুখ্যাত অর্ডিন্যান্স বাতিলসহ শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণ, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, জরুরি আইন, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ, অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত নেতা-কর্মীদের মুক্তি।

Comments
Post a Comment
Thanks for your comment